সরকার বিরোধী লেখকদের নাগরিকত্ব বাতিল চেয়ে রাজধানীতে মিছিল
মামুন হোসাইন, রাজনৈতিক সংবাদদাতা, ঢাকা
সরকারের বিভিন্ন বিষয়ের সমালোচনাকারী বিভিন্ন ব্লগার ও লেখকদের বিরুদ্ধে গতকাল রাজধানীর বাড্ডায় ছাত্রলীগের কর্মীরা এক প্রতিবাদ মিছিল বের করে। এই সময় কিছু উৎসাহী কর্মীদের ব্যানারে থাকা এইসব লেখকদের ছবির উপর জুতো দিয়েও আঘাত করতে দেখা যায়। ছাত্রলীগ কর্মীদের অভিযোগ এইসব লেখক ও ব্লগার দেশের বাইরে বসে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ব্লগে অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষায় মিথ্যে তথ্য সম্বলিত সংবাদ প্রকাশ করে। এই সময় ছাত্রলীগ ছাড়াও আওয়ামীলীগের মহাজোটের অংশ জাতীয় পার্টির অনেক ছাত্র নেতাকে এই মিছিলে দেখা যায়। এই মিছিল থেকে দাবী তোলা হয় যে, এইসব চিহ্নিত মিথ্যা গুজববাজদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে আজীবনের জন্য তাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল করতে হবে এবং আদালতে তাদের বিচার করতে হবে।
উল্লেখ্য যে এই লেখক ও ব্লগারদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন আদালতে গজব রটনার জন্য মামলা দায়ের করা হয়েছে। এইসব মামলার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে যুক্তরাজ্য প্রবাসী রেদোয়ানুর রহমান, নুরুল হুদা, জাওয়াদ নির্ঝর, জুলকার নাইন সায়ের, জনি জোসেফ কস্তা, কামরুল হাসান, বিপ্লব পাল, আশরাফ হোসাইন, সামিউজ্জামান সিদ্দিকির নাম উল্লেখযোগ্য। এই ছাড়াও সুইডেন থেকে নেত্র নিউজ পত্রিকার সম্পাদক জনাব তাসনিম খলিলের বিরুদ্ধে একাদফহিক মামলা দেশের বিভিন্ন আদালতে দায়ের করা হয়েছে।

আমাদের সংবাদদাতার সুত্রে জানা যায় যে, ‘ডেইলি নবজুগ’ নামক একটি অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে অতিমাত্রায় গুজব ছড়ানো হয় ও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটুক্তি করা হয়। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর ক্যানসার হয়েছে বলে গুজব ছড়ায় এবং দেশের রাজনীতি নিয়ে উষ্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান করে। এদিকে ঢাকায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে এই মিছিলের ফলে সেখানে জনমনে চাঞ্চল্য তৈরী হয়েছে। একটি সূত্রে জানায় সেখানে ছাত্রলীগ কর্মীদের তান্ডবে অনেক দোকান পাট বন্ধও হয়ে পড়ে।
এই ব্যাপারে বাড্ডা ছাত্রলীগের নেতা আকাশ আহমেদ বাবু’র কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এইসব গুজবকারীর স্থান বাংলার মাটিতে হবে না। এদের নাগরিকত্ব বাতিল করে এদের অনুপস্থিতেই এদের বিচার এই দেশে করতে হবে। নাগরিকত্ব বাতিলের আহবান জানিয়ে তার বিচার চাইছেন কিভাবে, এই প্রশ্নের উত্তরে বাবু বলে, নাগরিকত্ব বাতিল করে এবং দেশে না ফিরিয়ে এনেও এমন গুজবকারীদের বিচার করা যায়।
এই ব্যাপারে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হসেনের সাথে কথা বলার জন্য তাঁর মুঠোফোনে ফোন করলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এটা কেব্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ইতি মধ্যে মির্যা ফকরুলের জামাতা ও পিনাকী ভট্টচার্য্যের ব্যাপারেও তাদের নিজ নিজ শহরে ছাত্রলীগ প্রচারণা চালাবে। একই সাথে তিনি বলেন, আমরা শুনেছি এইসব গুজববাজরা লন্ডনে তারেক এবং বি এন পি’র সন্ত্রাসী আবদুল মালেকের সাথে একাত্ন হয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনে বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাংচুর করে। এত বড় স্পর্ধা দেখাবার জন্য শাতি তাদেরকে পেতেই হবে।
এই মিছিলের ব্যাপারে স্থানীয় কমিশনারের সাথে যোগাযোগ করলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। এই ব্যাপারে স্থানীয় বাড্ডা মডেল থানায় যোগাযোগ করা হলে তাঁরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বলে আমাদের প্রতিবেদককে জানান। কি কাজ করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে থানায় কর্তব্যরত কনস্টেবল মামুন আলী মন্তব্য করতে রাজি হন নি।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বাইরে বসে বিভিন্ন লেখক ও ব্লগাররা সরকারের নানাবিধ কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে লিখে যাচ্ছেন যেগুলোকে সরকার তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যে গুজব ও প্রোপাগান্দা বলে অভিহিতও করেছেন। জানা গেছে দেশের বাইরে বসে বিভিন্ন মাধ্যমে অপপ্রচারকারী তথা ‘দেশবিরোধী চক্রের’ ২২ জনের তালিকা করেছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ৩১তম বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে এ তথ্য জানানো হয়। কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খানের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স, মো. হাবিবে মিল্লাত ও নাহিম রাজ্জাক অংশ নেন।
বৈঠকে কমিটির সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ বলেন, সরকার তথা দেশবিরোধীদের ক্রমাগত অপপ্রচারের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কতিপয় দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করতে শুরু করেছে। এছাড়া সুইডেনের ‘নেত্র নিউজ’ একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।
তিনি আরও বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে বাংলাদেশবিরোধী একটি চক্র বিদেশে বসে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ ধরনের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সরকারের বক্তব্যগুলো বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার পাশাপাশি সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। মন্ত্রী ও কমিটির সদস্য এ কে আব্দুল মোমেন সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, ইউরোপের বেশ কিছু দেশে সরকার তথা দেশের বিরুদ্ধে একটি চক্র ব্যাপক আকারে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এগুলো প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তিনি কমিটির পরামর্শ কামনা করেন। মো. হাবিবে মিল্লাত বলেন, সরকারবিরোধী তথা দেশবিরোধী চক্রটি দেশের বাইরে বসে বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিয়ে দেশের মধ্যে একটি অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। স্বারাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেশবিরোধী চক্রের ২২ জনের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি দেশবিরোধী প্রচারণায় যে সব অসত্য তথ্য রয়েছে তা তুলে ধরে সঠিক তথ্যসম্বলিত প্রতিবেদন প্রচারের ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। এ ব্যাপারে দল থেকেও একটি দিকনির্দেশনা থাকা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
সদস্য নাহিম রাজ্জাক সরকার তথা দেশবিরোধী চক্রের ষড়যন্ত্রগুলো সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে হলে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পাশাপাশি বেশি করে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, ব্রাসেলসসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি দেশে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা বেশি হচ্ছে বিধায় তাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়া এবং কমিটির পক্ষ থেকে দেশগুলো সফর করার জন্য তিনি সভাপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, এসব দেশসমূহ আগামী ৬ মাসের মধ্যে ভিজিট করতে হবে, না হলে পরে কমিটির সদস্যরা সময় দিতে পারবেন না। তিনি আরও বলেন, দেশবিরোধী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে প্রচারণার ক্ষেত্রে ‘ঢাকা ডায়লগ’ একটি বড় প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। তাই এ অনুষ্ঠান বাংলাদেশে আয়োজনের ক্ষেত্রে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুনরায় অনুরোধ জানান।
সভাপতি বলেন, দেশবিরোধী চক্রের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোর কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এ ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে হবে। প্রয়োজনে সংসদীয় কমিটি এ ব্যাপারে সহযোগিতা প্রদান করবে বলে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করেন। এ সময় মন্ত্রী জানান সাজাপ্রাপ্ত আসামী বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব যুক্তরাজ্যে থাকার কারনে এখান থেকে গুজব বেশী ছড়ায়, এই কারনে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার তাসনিমা মুনকে দ্রুত ব্যবস্থা নেবার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক, ডেনমার্কে নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত, মন্ত্রণালয় এবং সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।