সংবিধান তৈরির কাজ শুরুর সিদ্ধান্ত

অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের আত্মজীবনী উতল রোমন্থন: পূর্ণতার সেই বছরগুলো। এতে উঠে এসেছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বইটি থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে।
আজ দ্বিতীয় কিস্তি

সংবিধানে ছয় দফা
কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির (সিএ) প্রথম অধিবেশন পূর্বানুমান করে এমন একটা কার্যকরী সংবিধান তৈরির কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলেন বঙ্গবন্ধু, ছয় দফা কর্মসূচির বিধান যাতে পুরোপুরি সংযুক্ত করা যায়। ছয় দফা কর্মসূচিকে নির্বাচনী বাগাড়ম্বরের ঊর্ধ্বে নিয়ে গিয়ে আলোচনার টেবিলে এবং সিএর সামনে সুচিন্তিত এবং দেশের পক্ষে কার্যকর একটি সাংবিধানিক কর্মসূচির তাৎপর্য বিস্তারিত আলোচনা করতে চাইলেন তিনি।

নির্বাচনের পরের সপ্তাহগুলোতে সংবিধান নিয়ে আলোচনার জন্য বেশ কিছু বৈঠক ডাকেন বঙ্গবন্ধু। এই বৈঠকগুলোতে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান এবং খন্দকার মোশতাক প্রমুখকে নিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড হাজির ছিল। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্য ড. কামাল হোসেন, যাঁকে তিনি তাঁর ছেড়ে দেওয়া ঢাকা আসনে মনোনীত করেন, নুরুল ইসলাম, মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী, সারওয়ার মুরশিদ, আনিসুর রহমান এবং আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন বঙ্গবন্ধু। আরটিসি এবং আওয়ামী লীগ কর্মসূচি নির্মাণে ইতিমধ্যে তিনি কামাল এবং অর্থনীতিবিদদের সক্রিয় করেছিলেন। মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী এবং সারওয়ার মুরশিদ ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই আওয়ামী লীগ নেতাদের বুদ্ধিজীবী সহযাত্রী ছিলেন। সে আন্দোলনে যুক্ত থাকায় মুজাফফরের জেলও হয়েছিল। মুরশিদের স্ত্রী নূরজাহান ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে প্রাদেশিক আইনসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ১৯৭০–এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটেই সিএর সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

বৈঠকগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে রাখা হয়েছিল, যদিও এই সব বৈঠক ও তাদের উদ্দেশ্য ইয়াহিয়া সরকারের গুপ্তচর সংস্থার কাছে একেবারে অজানা ছিল না। সংবাদমাধ্যমের নজর এড়াতে মিটিংগুলো হতো হামিদ নামে বঙ্গবন্ধুর বন্ধু ও অনুগত সমর্থক এক পাট ব্যবসায়ীর বাড়িতে। হামিদের বাড়ি ছিল বুড়িগঙ্গার পারে পুরান ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের মাঝামাঝি রাস্তায়। কনভয়ে চাপিয়ে সকালে আমাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হতো এবং সেখানে আমরা আটক থাকতাম রাত নামা পর্যন্ত। এই বিস্তারিত আলোচনার ফাঁকে সদ্য ধরা তাজা মাছের সুস্বাদু সব নানান পদ দিয়ে বড়সড় মধ্যাহ্নভোজ হতো।

সেই দীর্ঘ ও গভীর আলোচনার দিনগুলোয় কামাল হোসেনসহ শিক্ষাবিদ অংশগ্রহণকারীরাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতেন। আর পণ্ডিতদের মতোই প্রজ্ঞাময় অবদান রাখতেন তাজউদ্দীন আহমদ, যা থেকে তাঁর গভীর রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি, দ্বান্দ্বিক দক্ষতা এবং জটিল প্রায়োগিক বিষয় আত্মীকরণ এবং সেগুলোকে তাদের মৌলিক উপাদানে খণ্ডিত করার দক্ষতার পরিচয় মিলত। বঙ্গবন্ধু নিজেও এসব আলোচনায় একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন—তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও তীক্ষ্ণ বাস্তববোধে উপকৃত হতাম আমরা।

আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ছয় দফা দাবি বস্তুত পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়ার সমতুল্য কি না অথবা তাকে সংযুক্ত পাকিস্তানের কাঠামোয় জায়গা দেওয়া যেতে পারে কি না, তা খতিয়ে দেখা। পাকিস্তানি শাসক মহলের বিবেচনায় ছয় দফা ছিল সূক্ষ্ম পর্দার আড়ালে বিচ্ছিন্নতার নকশা। শোনা যেত এম এম আহমেদ, কামরুল ইসলামের মতো অর্থনীতির কর্তাব্যক্তিরা আইয়ুব ও ভুট্টোকে এমনটাই বুঝিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের পাকিস্তানি প্রতিপক্ষের এই আশঙ্কা সমর্থন করে ডেইলি স্টার পত্রিকায় লেখা অধ্যাপক নুরুল ইসলামের একটি প্রবন্ধ, যেখানে তিনি ছয় দফার অন্তর্নিহিত বিচ্ছিন্নতবাদী অ্যাজেন্ডাগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

আমাদের এই নিবিড় বিতর্কগুলোর সময় বুড়িগঙ্গার তীরে সমবেত শিক্ষাবিদদের কাছে বিশেষভাবে যা বুঝতে চাইতেন তা হলো, সংযুক্ত পাকিস্তানের সাংবিধানিক কাঠামোয় বস্তুতই ছয় দফাকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব কি না। আমাদের যুক্তি ছিল যে ছয় দফাকে অধিভুক্ত করে একটা বৈধ সংবিধান কার্যকরী করা যাবে শুধু যদি রাজনৈতিক সংকটের সাংবিধানিক সমাধান খোঁজার আন্তরিক ইচ্ছা সেনাবাহিনীর থাকে। আলোচনার ফল হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে ছয় দফার ওপর দৃঢ়প্রত্যয় রাখতে সাহায্য করেছিল আমাদের সমর্থন। পাকিস্তানি সামরিক শাসকচক্র শান্তিপূর্ণভাবে ছয় দফা কার্যকর হতে দেবে কি না, এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর যে সংশয় ছিল, তা এ থেকে প্রভাবিত হয়নি। আমাদের দলের কাজ শেষ হলে একটা সাংবিধানিক খসড়া এবং ভবিষ্যতের কোনো সম্ভাব্য রাজনৈতিক আলাপ–আলোচনার জন্য সম্পূর্ণভাবে ছকে দেওয়া একটা অবস্থান আওয়ামী লীগ পেয়ে গিয়েছিল।

* ছয় দফা কর্মসূচিকে নির্বাচনী বাগাড়ম্বরের ঊর্ধ্বে নিয়ে গিয়ে আলোচনার টেবিলে আনা হলো। * নির্বাচনের পরের সপ্তাহগুলোতে সংবিধান নিয়ে আলোচনার জন্য বেশ কিছু বৈঠক ডাকেন বঙ্গবন্ধু। বৈঠকগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে রাখা হয়েছিল, যদিও এসব বৈঠক ও তাদের উদ্দেশ্য ইয়াহিয়া সরকারের গুপ্তচর সংস্থার কাছে একেবারে অজানা ছিল না।

এই বৈঠকগুলোর কিছুদিন পর কিছু সংবাদমাধ্যম আমাদের খসড়ার ওপর খবর করে। বঙ্গবন্ধু সন্দেহ করেন যে খসড়াটা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ফাঁস করে দিয়েছিলেন গোপন বৈঠকে অংশ নেওয়া কোনো একজন। তাঁর অনুমান ছিল ব্যক্তিটি খন্দকার মোশতাক হতে পারেন। মোশতাক ছয় দফার বিষয়ে আপসরফার পক্ষপাতী ছিলেন বলে মনে করা হতো এবং ছয় দফায় কার্যকারিতা সম্পর্কে অর্থনীতিবিদেরা বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়ে রাজি করাতে এতটা উদ্যোগী হবেন, সেটা তাঁর ভালো লাগেনি। আমাদের যুক্তি খণ্ডনের ক্ষমতা বা সাহস খন্দকারের ছিল না, কিন্তু বিকল্প খুঁজতে অন্য অর্থনীতিকদের মতামত নেওয়ার পরামর্শ তিনি বঙ্গবন্ধুকে দেন। তাঁর পরামর্শ বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করেনি। দিনের শেষে খসড়ার সব কপি এবং আমাদের আলোচনার সব নোট তাঁর কাছে হস্তান্তরের পরামর্শ দেন যাতে সেগুলো তাঁর জিম্মায় নিরাপদ থাকে। কার্যত অপরাধ স্বীকারের ভঙ্গিমায়, সহযোগীদের ওপর বঙ্গবন্ধুর এই আস্থাহীনতার প্রদর্শনে আমাদের মধ্যে একমাত্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন মোশতাক।

গণতান্ত্রিক সমাধানের খোঁজে
আওয়ামী লীগ তার সাংবিধানিক খসড়া তৈরি করে ফেলার পর আমাদের দরকার ছিল অন্যান্য রাজনৈতিক পক্ষের অবস্থান জানা। পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে অপ্রত্যাশিতভাবে নির্বাচন জেতার পর পিপিপির রাজনৈতিক অবস্থান নির্ণয় করতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি জানতে চাইছিলেন সংবিধানের ব্যাপারে কোনো গভীর ভাবনা পিপিপির আছে কি না এবং নির্বাচনী প্রচারে গুরুত্ব না দেওয়া ছয় দফার বিষয়ে তাদের প্রকৃত অবস্থান কী।

পিপিপি নেতৃত্বের মনোভাব বুঝতে বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন ১৯৭১–এর জানুয়ারিতে এক অনানুষ্ঠানিক সফরে পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে আমাকে অনুরোধ করেন। যেহেতু শিক্ষাবিষয়ক বৈঠকে আমাকে নিয়মিত পশ্চিম পাকিস্তান যেতেই হতো, তাই ধরে নেওয়া হয়েছিল যে আমার সফর আলাদা করে কোনো জল্পনা উসকে দেবে না। পিপিপির কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে আমি আবার ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ছিলাম, যার ফলে তাঁদের ভাবনাচিন্তা ও নেতৃত্বের নাগাল পাওয়া আমার পক্ষে সহজ ছিল।
এ সফরের সময় ফোরামে আমাদের সহকর্মী মাজহার আলী খানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। লাহোরের পিপিপি নেতাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল, আমার লাহোর মিশনের বন্দোবস্ত করতে যা কাজে লাগে। গুলবার্গে তাঁর ছোট কিন্তু সুন্দর ও রুচিসম্মতভাবে সাজানো বাড়িতে তিনি ও তাঁর স্ত্রী তাহিরার সঙ্গে থাকার আমন্ত্রণ করেন মাজহার। তিনি আমার লাহোরের কর্মসূচি ঠিক করে দেন এবং সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে তিনিই আমাকে গাড়িতে করে পৌঁছে দিতেন। তাঁর মাধ্যমে আমি আলাদাভাবে পিপিপির ড. মোবাশ্বের হাসান আর মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরীর সঙ্গে দেখা করি। তাঁরা দুজন পিপিপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং তাঁরাই দলের মূল মস্তিষ্ক বলে শোনা যেত। পাকিস্তানের বিখ্যাত আইনজীবীদের একজন কাসুরী ছিলেন ন্যাপের সদস্য এবং সে কারণে বামপন্থী হিসেবে পরিচিতি ছিল তাঁর। তাঁর সংস্কারপন্থী পরিচয় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছিল। নোবেলজয়ী দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর প্রতিষ্ঠিত ভিয়েতনামবিষয়ক আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে যোগ দিতে কাসুরীকে আমন্ত্রণ জানান। মোবাশ্বের অত পরিচিত ছিলেন না, তবে বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার মোবাশ্বেরের কড়া বামপন্থী মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে যখন ১৯৭২ সালে। তাঁর প্রথম মন্ত্রিসভায় ভুট্টো তাঁকে অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। মোবাশ্বেরের সঙ্গে আমার আলোচনা ছয় দফায় থেকে বেশি অর্থনৈতিক নীতি বিষয়েই হয়েছিল। আলাপচারিতায় আমি দেখলাম যে পিপিপির বামপন্থী ডানা বলে যাদের ভাবা হতো, দলের মহাসচিব অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক এবং তথাকথিত পিপিপি ভাবাদর্শী জে আর রহিম এবং মিরাজ মোহাম্মদ খানের মতো কনিষ্ঠ অনুগতরা, তাঁর সবাই ছয় দফা প্রসঙ্গে আলোচনা এড়িয়ে গেলেন। তাঁরা যুক্তি দেখালেন যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানের প্রাথমিক লক্ষ্য সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্র উচ্ছেদ এবং এই বিপ্লব অবশ্যই বাঙালিদের কেড়ে নেওয়া অধিকার প্রত্যর্পণ করবে। এ ধরনের কেতাবি কথাবার্তা আমার কাছে খুব নিরাশাজনক মনে হলো। কারণ, সে সময় পাকিস্তানি রাজনীতির আসল যে দ্বন্দ্ব—পূর্ব–পশ্চিম বিভেদ—তা থেকেই দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছিল এই আলোচনা।

৬ দফার আন্দোলন
৬ দফার আন্দোলন

আমি বুঝিনি মিয়া কাসুরীর পাঞ্জাবি আনুগত্য মানবাধিকারের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতাকে ছাপিয়ে যাবে। কাসুরী বিশিষ্ট আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে দেখে আমার মনে হয়েছিল সংবিধান রচনার বিষয়ে তেমন কোনো গভীর চিন্তা তিনি করেননি এবং জাতীয় সংহতির ব্যাপারে বুলিসর্বস্বতা ছাড়া আর কিছু তাঁর দেওয়ার নেই। স্বাধীনতার পর আমি জেনে মজা পেয়েছিলাম যে কাসুরীর বাড়িতে একান্ত নৈশভোজে সামরিক শাসন অবসানে আওয়ামী লীগ এবং পিপিপির একযোগে কাজ করার প্রয়োজন বিষয়ে আমার কিছু উক্তি তিনি সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীকে জানিয়ে দেন। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অ্যাবোটাবাদের কাছে হরিপুর জেলে বন্দিদশায় কামাল হোসেনকে জেরা করতে গিয়ে সামরিক গোয়েন্দা পক্ষ এ কথা প্রকাশ করে। কামালের জেরাকারীরা তাকে বলেছিল যে তার মামাতো ভাই রেহমান সোবহান পিপিপিকে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বলতেই হয়, একজন বামপন্থীর পক্ষে বেশ শ্লাঘনীয় হয়েছিল ব্যাপারটা।বিজ্ঞাপন

লাহোর থেকে করাচি এসে প্রথমেই আমার সেন্ট পলসের বন্ধু ব্যারিস্টার রাফি রাজার সঙ্গে যোগাযোগ করি। মার্চ ১৯৬৯ সালে লন্ডন থেকে ফেরার সময় আমি রাফির সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ করেছিলাম। রাফির সঙ্গে ভুট্টোর পরিচয় ব্রিজ টেবিলে এবং ভুট্টো তাকে পিপিপি প্রতিষ্ঠায় যোগ দিতে উৎসাহিত করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে পিপিপির জয়ের পর ভুট্টোর সাংবিধানিক পরামর্শদাতা মনোনীত হয় রাফি।

রাফির সঙ্গে আলোচনা করে আমি জানতে পারি আসন্ন সিএর জন্য পিপিপির সাংবিধানিক অবস্থানের খসড়া তৈরি করতে তাকে নিয়োগ করেছেন ভুট্টো। বুড়িগঙ্গাতীরে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তার সূত্রে ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনার কিছু বাস্তব দিক নিয়ে আলোচনার অংশ নেওয়াতে চেয়েছিলাম রাফিকে। ছয় দফার বিরুদ্ধে সে এবং ভুট্টোসহ তার পিপিপি–সতীর্থদের নির্দিষ্ট অভিযোগগুলো কী, সেটা রাফির কাছে জানতে চেয়েছিলাম আমি। আমার প্রশ্নের জবাব রাফি দিতে পারেনি। এ বিষয়ে কোনো কাজই সে করেনি যেহেতু সংবিধান তৈরির সূক্ষ্ম দিকগুলো খতিয়ে দেখার তেমন আগ্রহ ভুট্টোর ছিল না। রাফি আমাকে পরে বলে তার ইংরেজ বউ রোজমেরি, যে আমাদের সেই আলোচনায় হাজির ছিল, তাকে বলেছে যে আওয়ামী লীগ তাদের সংবিধান তৈরিতে অনেক বেশি পেশাদারি মনোভাব দেখিয়েছে: তুলনায় তার কাছে মনে হয়েছে পিপিপি এক অ্যামেচার দল। পরে ভুট্টোর মুখ্য লেফটেন্যান্টদের একজন ব্যারিস্টার আব্দুল হাফিজ পীরজাদার সঙ্গে আমার আলোচনায় এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছিল।

ব্যারিস্টার কামাল আজফারের সঙ্গে মার্চ ১৯৬৯–এ আমার আলাপ হয়েছিল। আমি তার সঙ্গেও কথা বলি। কামাল সে সময় কিছুটা অবিবেচকভাবে মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিল। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ছিলেন মিয়া মমতাজ দৌলতানা, অনেকের ধারণায় যিনি ছিলেন পাঞ্জাবের যেকোনো নির্বাচন থেকে জয়ী হয়ে আসার মতো মুখ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এই মোহভঙ্গ হলো যখন নির্বাচনে পিপিপি মুসলিম লীগকে উৎখাত করল। নির্বাচনের পর কামাল কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই ভুট্টোর সঙ্গে ব্রিজ খেলার টেবিলে অন্তরঙ্গতা কাজে লাগিয়ে আনুগত্য বদল করে পিপিপিতে যোগ দেয়। ইস্কান্দার মির্জার দ্বিতীয় স্ত্রী তরুণী নাহিদ মির্জার সঙ্গে ব্রিজ খেলার টেবিলে আলাপের সূত্রে ৩২ বছরের যুবক ভুট্টোকেই ইস্কান্দার মির্জা এবং ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন কেবিনেটে নিয়ে আসে। মনে হয়, এই মহান খেলা ভুট্টোর রাজনৈতিক জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

ইতিমধ্যে ভুট্টোর ঘনিষ্ঠ সার্কেলের সদস্য হয়েছে কামাল, সুতরাং আমি আশা করেছিলাম সে অথবা রাফি আমাকে ভুট্টোর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। রাফি ও কামালকে আমি বোঝাই যে নির্বাচনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন হয়েছে। ছয় দফা বরং এখন রক্ষণশীল অবস্থান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে যেহেতু স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য আরও চরমপন্থী মত তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে। সামরিক জান্তা এবং পিপিপি যদি ছয় দফা মেনে নিতে অনিচ্ছুক হয় তবে তাদের সজাগ হওয়া ভালো যে বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মোকাবিলা তাদের করতে হবে। কামাল আজফার ভুট্টোকে আমার মতামত জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি আলোচনার জন্য আমার সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দেয়। ভুট্টোর তা করার ইচ্ছে ছিল না এবং আমাকে ও আমার মতামতকে ঢাকার রাজনৈতিক চিন্তার মূলস্রোত বিচ্ছিন্ন বিবেচনা করে খারিজ করে দেয়। সে বুঝিয়েছিল যে আমি মাথা গরম চরমপন্থী হিসেবে পরিচিত। নির্বাচনের আগে ঢাকা সফরের সময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ঘরে তাঁর সঙ্গে আমার ও কামালের উত্তপ্ত বাদানুবাদের কথা হয়তো সে মনে রেখেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *