বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন অবৈধ সম্পদশালীরা

ক্যাসিনো গডফাদার যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের মামলায় চার্জশিট দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সেখানে বলা হয়েছে, অবৈধ কার্যক্রমের মাধ্যমে সম্রাট ২২২ কোটি ৮৮ লাখ ৬২ হাজার ৪৯৩ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে তা নিজ ভোগদখলে রেখেছেন।

অপরাধলব্ধ আয়ের ২১৯ কোটি ৪৮ লাখ ৫৮ হাজার ৫০০ টাকা সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় পাচার করেছেন। সেদেশের দুটি ক্যাসিনো থেকে তিনি ১২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ক্যাশ-আউট বা খালাস করে নিজের কাছে গচ্ছিত রেখে হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং (অর্থ পাচার) করেছেন। চার্জশিটে মোট ২১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।

আগামী ৩১ মার্চ এ চার্জশিট আমলে গ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কেএম ইমরুল কায়েশ এ চার্জশিট গ্রহণ করবেন। এরপর আদালত আসামির বিরুদ্ধে চার্জ (অভিযোগ) গঠন করলেই মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হবে। শুধু সম্রাটই নন, ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার হওয়া অন্তত হাফ ডজন অবৈধ সম্পদশালীর বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। তারা হলেন : ইসমাইল হোসেন সম্রাট, জি কে শামীম, সেলিম প্রধান, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জাকির হোসেন ও কাজী আনিছ দম্পতি। এ ছাড়া আরও সাতজনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ মামলার তদন্তও শেষ পর্যায়ে। শিগগির এসব মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হবে। এরা হলেন : লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, এনামুল হক এনু, রূপন ভূঁইয়া, তারেকুজ্জামান, পাগলা মিজান, আরমান ও পাপিয়া দম্পতি। এসব অবৈধ সম্পদশালীর মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশে অর্থ পাচারের তথ্য জানতে এবং পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনতে এরইমধ্যে নানা উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। যথাযথ অনুসন্ধান ও তদন্তের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদশালীদের বিচারের মুখোমুখি করে কমিশন এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়, যাতে আর কেউ ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়ানোর সাহস না পায়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে প্রায় তিন মাসব্যাপী সারা দেশে পরিচালিত হয় ওই ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, এই (ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী) অনুসন্ধান ও তদন্তের বিষয়ে কমিশন অত্যন্ত সজাগ দৃষ্টি রাখছে। যেসব সম্পদ বিদেশে পাচার হয়েছে, সেগুলো দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কমিশন থেকে নির্দেশনা দেওয়া আছে। ইতোমধ্যে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার জন্য মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে একাধিক এমএলএআর (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্ট রিকোয়েস্ট) পাঠানো হয়েছে। যদিও এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তবে আমরা আশা করছি, পাচার এসব অর্থ আমরা এক সময় উদ্ধারে সক্ষম হব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা যাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অভিযোগ পেয়েছি, প্রাথমিক প্রমাণসাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আমরা এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই, যাতে এই ক্যাসিনোকাণ্ডে কেউ জড়ানোর সাহস না পায়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট দুদকের একাধিক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, ক্যাসিনোকাণ্ডে দুই দফায় ১৭৮ জনের তালিকা ধরে অনুসন্ধান চলছে। এর মধ্যে রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ও অনেকের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় ইতোমধ্যে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত। আর যেসব মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়নি। সেগুলোর তদন্তও শেষ পর্যায়ে। শিগগির ওইসব মামলায়ও আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে।

জি কে শামীম : অবৈধভাবে ২৯৭ কোটি ৮ লাখ ৯৯ হাজার ৫৫১ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর প্রভাবশালী ঠিকাদার জি কে শামীমের (এসএম গোলাম কিবরিয়া শামীম) বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। তদন্ত শেষে এ বছরের ১৭ জানুয়ারি আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়। চার্জশিটে ২৯৭ কোটি ৩৯ লাখ ১২ হাজার ৭৮৯ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ করা হয়। আর চার্জশিটে জি কে শামীমের সঙ্গে তার মা আয়েশা আক্তারকেও আসামি করা হয়েছে। আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি মামলার পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

সেলিম প্রধান : অবৈধভাবে ১২ কোটি ২৭ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫৪ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনোর মূল হোতা মো. সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর দুদকের উপ-পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে মামলাটি করেন। তদন্ত শেষে এ বছরের ১৭ জানুয়ারি আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়। আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি এ মামলার পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া : জ্ঞাত আয়বহির্ভূত পাঁচ কোটি ৫৮ লাখ ১৫ হাজার ৮৫৯ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর দুদকের উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে মামলাটি করেন। তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়। চার্জশিটে ৪২ কোটি ৭৫ লাখ ৭০ হাজার ৭৫৬ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ করা হয়। এ ছাড়া তিনি মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে পৃথক তিনটি ব্যাংকে মোট আট কোটি ৭৪ লাখ ৩৩ হাজার ৯৬ টাকা জমা করে মানি লন্ডারিং করেছেন। আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি এ চার্জশিট আমলে গ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

জাকির হোসেন : যুবলীগ নেতা সম্রাটের কথিত ডানহাত জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি ৪৯ লাখ তিন হাজার ৯৩৮ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করা হয়। ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি করেন। তদন্ত শেষে এ বছরের ১৮ জানুয়ারি আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়। চার্জশিটে পাঁচ কোটি ৮৬ লাখ সাত হাজার ৬৯ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ করা হয়। আগামী ২১ মার্চ এ চার্জশিট আমলে গ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

কাজী আনিছুর রহমান : যুবলীগের বহিষ্কৃত দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ১২ কোটি ৮০ লাখ ৬০ হাজার ৯২০ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করা হয়। ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে মামলাটি করেন। তদন্ত শেষে সম্প্রতি এ মামলার চার্জশিট অনুমোদন করেছে কমিশন। চার্জশিটে আনিছুর রহমানের ১৪ কোটি ৯৫ লাখ ২৯ হাজার ৮৩৬ টাকা এবং তার স্ত্রী সুমী রহমানের দুই কোটি ৬১ লাখ ৬২ হাজার ২১৮ টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগ করা হয়েছে। শিগগির এ চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে।

লোকমান হোসেন ভূঁইয়া : বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে চার কোটি ৩৪ লাখ ১৯ হাজার ৬৪৮ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করা হয়। ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর দুদকের সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলাটি তদন্তের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। শিগগির আদালতে এ মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এনামুল হক এনু : গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনুর বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ২১ কোটি ৮৯ লাখ ৪৩ হাজার ৭৭৩ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করা হয়। ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে।

রুপন ভূঁইয়া : গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক রুপন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ১৪ কোটি ১২ লাখ ৯৫ হাজার ৮৮২ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করা হয়। ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নেয়ামুল আহসান গাজী বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এ মামলাটিও তদন্তের শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

তারেকুজ্জামান রাজীব : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিল মো. তারেকুজ্জামান রাজীবের বিরুদ্ধে ২৬ কোটি ১৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগে মামলা করা হয়। ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলাটি তদন্তাধীন।

পাগলা মিজান : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানের বিরুদ্ধে ৩০ কোটি ১৬ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করা হয়। ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এ মামলাটিও তদন্তাধীন।

আরমান : সম্রাটের সহযোগী যুবলীগ নেতা আরমানের বিরুদ্ধে দুই কোটি পাঁচ লাখ ৪০ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করা হয়। দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলাটি তদন্তের শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

পাপিয়া দম্পতি : নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ দম্পতির বিরুদ্ধে ছয় কোটি ২৪ লাখ ১৮ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগে মামলা করা হয়। গত বছরের ৪ আগস্ট কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি করা হয়। তদন্ত শেষে গত ১১ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে কমিশন। চার্জশিটে পাপিয়া দম্পতির পাঁচ কোটি ৮৪ লাখ ১৮ হাজার ৭১৮ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। শিগগির এ চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে।43Shares

facebook sharing button
messenger sharing button
twitter sharing button
pinterest sharing button
linkedin sharing button
print sharing button

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *