টিকার অগ্রাধিকার তালিকা নিয়ে প্রশ্ন

করোনাভাইরাসের টিকা প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পরিকল্পনা চূড়ান্ত না হওয়ায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকাপ্রাপ্যদের তালিকাও চূড়ান্ত হচ্ছে না। এ নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের বিভ্রান্তি। খসড়া তালিকা অনুসারে কোন ক্যাটাগরির কারা, কতজন টিকা পাবে তাও সঠিকভাবে জানতে পারছে না কেউ। যদিও খসড়া অনুসারে আগামী সপ্তাহ নাগাদ দেশে প্রথম আসা টিকা থেকে প্রথম ডোজ পাবে প্রথম পর্যায়ের ১৯ ক্যাটাগরির অগ্রাধিকারের শীর্ষে থাকা করোনা প্রতিরোধে সম্মুখ সারির মানুষসহ বয়স্ক জনগোষ্ঠীর একাংশ। সে লক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন দপ্তর বা পেশাজীবীদের কাছে তালিকা চাওয়ার কথা থাকলেও অনেকে এখনো সে চিঠি পায়নি। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে এত দেরি করলে প্রস্তুতি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সঠিকভাবে হবে না, বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, কয়েক দিন আগেই অধিদপ্তর পর্যায়ের চূড়ান্ত খসড়া মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে অনুমোদনের জন্য। কিন্তু এখনো তা অনুমোদিত হয়নি। ফলে খসড়া ধরেই অনেকটা এগিয়েছে প্রস্তুতি। অন্যদিকে পরিকল্পনা চূড়ান্ত না হওয়ায় এতে কী আছে না আছে তা সঠিকভাবে জানতে পারছে না মানুষ। গণমাধ্যমও যে যার সূত্র ধরে খসড়া পরিকল্পনার তথ্য তুলে ধরছে, যা নিয়ে বিভ্রান্তিরও সুযোগ থেকে যাচ্ছে। আবার পরিকল্পনা চূড়ান্ত না হওয়ার অজুহাত তুলে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করে কিছুই জানাতে পারছেন না।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব (স্বাস্থ্যসেবা) আব্দুল মান্নান কালের কণ্ঠকে গতকাল শনিবার বলেন, ‘অধিদপ্তর থেকে খসড়া আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। আমরা সেটা এখনো পর্যালোচনা করছি। আরো কিছুটা সময় লাগবে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য। তবে কোনো কাজ থেমে নেই। প্রস্তুতি এগিয়ে চলছে। সময়মতোই সব কিছু হবে। ২৬ জানুয়ারি থেকেই নিবন্ধন শুরু হবে।’

খসড়া পরিকল্পনার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রের তথ্য অনুসারে মোট জনগোষ্ঠীর ৩ শতাংশ হিসাবে প্রথমে ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ২৮২ জনের টিকা পাওয়ার কথা রয়েছে। তবে আগামী সপ্তাহে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ডের টিকা প্রথম লটে আসবে ৫০ লাখ ডোজ। এই ৫০ লাখ টিকা ৫০ লাখ মানুষকে দেওয়া হবে। দ্বিতীয় দফায় পাবে ৪-৭ শতাংশ হিসাবে এক কোটি ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৭ জন। তৃতীয় দফায় ১১-২০ শতাংশ হিসাবে পাবে এক কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার ৯৩৮ জন। পরের ধাপে ২১-৪০ শতাংশের মধ্যে পাবে তিন কোটি ৪৫ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৭ জন এবং শেষ ভাগে ৪১-৮০ শতাংশের আওতায় পাবে ছয় কোটি ৯১ লাখ ২৩ হাজার ৭৫৪ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (টিকাদান) ডা. সামসুল হক বলেন, ‘পরিকল্পনা চূড়ান্ত না হলেও আমরা টিকাদান সংক্রান্ত খসড়া পরিকল্পনা ও কৌশলকে সামনে রেখে সব কাজ এগিয়ে নিচ্ছি। তালিকা প্রস্তুত, কোন ক্যাটাগরির কতজন টিকা পাবে—সেগুলো গুছিয়ে রাখছি।’

টিকাসংক্রান্ত পরিকল্পনাপত্র অনুসারে দেখা যায়, দেশে টিকা আসার পর এ মাসের মধ্যেই একাধিক প্রতিষ্ঠানের কিছুসংখ্যক বাছাইকৃত নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীকে টিকা দেওয়া হবে। এরপর অন্যদের টিকা দেবে। এর পরই আগামী মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হবে আনুষ্ঠানিকভাবে টিকা প্রয়োগ। এ ক্ষেত্রে সবার আগে টিকা পাবেন সরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রে সরাসরি করোনা রোগীদের সেবায় কাজ করা চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান, ধাত্রী, ফিজিওথেরাপিস্ট, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী ও অ্যাম্বুল্যান্সচালক, যাঁদের সংখ্যা তিন লাখ ৩২ হাজার ২৭ জন।

পরে বেসরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রে সরাসরি করোনা রোগীদের সেবায় কাজ করা চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান, ধাত্রী, ফিজিওথেরাপিস্ট, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী, অ্যাম্বুল্যান্সচালকদের মধ্য থেকে ছয় লাখকে টিকা দেওয়া হবে। একই ধাপে এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করা অন্যান্য বিভাগের আরো এক লাখ ২০ হাজার চিকিৎসক-নার্স ও অন্যান্য; দুই লাখ ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা; পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার ৬১৯ জন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য (যাঁরা সরাসরি করোনাসংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালন করেছেন); সশস্ত্র বাহিনীর তিন লাখ ৬০ হাজার সদস্য পাবেন টিকা। বিচার বিভাগ, মন্ত্রণালয়, সচিবালয়, জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের পাঁচ হাজার (সংখ্যা আরো কিছু বাড়বে) শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাও টিকা পাবেন প্রথম ধাপেই।

সাংবাদিকদের মধ্যে যাঁরা সরাসরি করোনার খবরাখবর সংগ্রহে কাজ করেছেন এমন ৫০ হাজার জন টিকা পাবেন প্রথম লট থেকেই। একই সঙ্গে টিকা পাবেন সংসদ সদস্য, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এক লাখ ৭৮ হাজার ২৯৮ জন, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার এক লাখ ৫০ হাজার জন, ষাটোর্ধ্ব বয়সের ধর্মীয় নেতা পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার, দাফন ও সৎকারকর্মী ৭৫ হাজার, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিদ্যুৎ-পানি, গ্যাস ও অগ্নিনির্বাপক কর্মী চার লাখ, বন্দরের কর্মকর্তা ও কর্মী এক লাখ ৫০ হাজার, বিদেশগামী অদক্ষ শ্রমিক এক লাখ ২০ হাজার, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী চার লাখ, ব্যাংক কর্মী এক লাখ ৯৭ হাজার ৬২১ জন, যক্ষ্মা, এইচআইভি ও ক্যান্সার রোগী ছয় লাখ ২৫ হাজার, অন্যান্য জরুরি সেবায় জড়িত ৭৭ হাজার ৮০৪ জন। প্রথম ধাপের এই সংখ্যার মধ্য থেকেই কিছুটা সমন্বয় করে ষাটোর্ধ্ব কিছুসংখ্যক মানুষকেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।

খসড়া পরিকল্পনা অনুসারে দ্বিতীয় ধাপে মোট জনগোষ্ঠীর ৭ শতাংশের আওতায় এক কোটি ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৭ জন ষাটোর্ধ্ব মানুষ; তৃতীয় ধাপের ৫০-৫৫ বছরের ৫৫ লাখ ৬৬ হাজার ৭৫৭ জন, ৪০-৪৯ বয়সের ১৭ লাখ ৮৮ হাজার ৫৩ জন বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষক, গণমাধ্যমের বাকিদের মধ্য থেকে আরো ৫০ হাজার, পার্বত্য অঞ্চল ও দুর্গম অঞ্চলের এক লাখ ১১ হাজার ২২৮ জন, ক্ষুদ্রজাতির ১২ লাখ বাসিন্দা, পাঁচ লাখ পরিবহন শ্রমিক, দুই লাখ ৪২ হাজার ৯৬৪ জন হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ফার্মেসি কর্মী, ৩৬ লাখ গার্মেন্টকর্মী, অন্যান্য তিন লাখ ধরে এই পর্বে শেষ হবে।

খসড়া পরিকল্পনার তথ্য অনুসারে, এরপর পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে দেওয়া হবে মোট তিন কোটি ৪৫ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৭ জনকে টিকা। এর মধ্যে থাকবেন শিক্ষকদের ভেতর থেকে আগের ধাপে বাদ পড়া আরো ছয় লাখ ৬৭ হাজার ২০৪ জন, প্রসূতি নারী (যদি তাঁরা টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপদ বলে ঘোষিত হন) ৩৮ লাখ ১৫ হাজার ২০১ জন, সরকারি অন্যান্য ১২ লাখ ১৭ হাজার ৬২ জন কর্মচারী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরো ৪৩ লাখ সদস্য, আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত জনবলসহ সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার অন্যান্য কর্মচারী ছয় লাখ, অন্যান্য আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বাকিদের মধ্য থেকে ২২ লাখ, আমদানি-রপ্তানিতে জড়িত দুই লাখ ৮১ হাজার ৮৮৪ জন, বেসরকারি কর্মী ২৫ লাখ, কারাবন্দি ও কারারক্ষী ৯৭ হাজার ২৪৫ জন, বস্তিবাসী ও ভাসমান মানুষদের মধ্যে ২২ লাখ ৩২ হাজার ১১৪ জন, কৃষি ও খাদ্য খাতের কর্মী ১৬ লাখ ৫০ হাজার, আবাসিক কর্মী পাঁচ লাখ, গৃহহীন দুই লাখ, অন্যান্য কারখানা কর্মী ৫১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৪৪ জন, বাকি থাকা পরিবহন শ্রমিকদের মধ্য থেকে আরো তিন লাখ, ৫০-৫৪ বছরের জনগোষ্ঠীর বাকিদের মধ্য থেকে আরো ৬৫ লাখ ৪৬ হাজার ৩২৩ জন, অন্যান্য জরুরি ব্যবস্থাপনায় জড়িত পাঁচ লাখ।

সর্বশেষ ধাপে দেওয়া হবে তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে তিন কোটি ২২ লাখ ৩৪ হাজার জন, শিশু ও স্কুলগামীদের মধ্য থেকে তিন কোটি ৬০ লাখ ৪৭ হাজার ১৫৭ জন এবং বাকি অন্যদের মধ্য থেকে আরো আট লাখ ৪২ হাজার ৫৯৭ জন।

অবশ্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক সাম্প্রতিক বিভিন্ন সভা ও ব্রিফিংয়ে বলে আসছেন, ১৮ বছরের নিচের কেউ আপাতত টিকার আওতায় থাকছে না।

ডা. সামসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে অনেক ক্যাটাগরির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের কাছে তালিকা চেয়েছি। কিছু পেয়েছি, কিছু পাইনি। আরো কিছু সংগঠনের কাছে দু-এক দিনের মধ্যেই তালিকা চাইব। সমস্যা হচ্ছে কোনো কোনো পেশাজীবী সংগঠনের একই ব্যক্তি একাধিক সংগঠনের সদস্য। সেটা কিভাবে সমন্বয় করা যাবে তা নিয়ে ভাবনার বিষয় আছে। কারণ একই ব্যক্তি যেন একাধিকবার টিকার প্রাপক হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন তালিকাভুক্ত না হন সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ন্যাশনাল আইডি কার্ডকে আমরা টুলস হিসেবে ব্যবহার করব। কিন্তু এর পরও কিছুটা জটিলতার আশঙ্কা তো থাকেই।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *