কুয়েতে শহিদের সাজা আরও বাড়তে পারে

কুয়েতে বাংলাদেশি সাংসদ মো. শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুলের কারাদণ্ড হয়েছে ঘুষ লেনদেনের দায়ে। তাঁর বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচারের অভিযোগের বিচার এখনো বাকি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মুদ্রা পাচারের দায় এড়ানো সাংসদের জন্য কঠিন হবে। সে ক্ষেত্রে তাঁর সাজা আরও বাড়তে পারে।

কুয়েতের সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে মানব পাচারের অভিযোগে সাংসদ শহিদকে গত বৃহস্পতিবার চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫৩ কোটি টাকা জরিমানার সাজা দেন দেশটির আদালত। এ মামলায় কুয়েতের তিন নাগরিকের পাশাপাশি সাংসদ শহিদের তিন সহকর্মী এবং সিরিয়ার এক নাগরিককে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আর খালাস পেয়েছেন কুয়েতের দুই সাংসদ এবং পাপুলের তিন সহকর্মী।

—জাল চুক্তিতে বাংলাদেশিদের কুয়েতে নিতেন সাংসদ।
—অমানবিক পরিবেশে কাজ করানো হতো। অভিযোগ করলেই মারধর।

এই মামলা সংশ্লিষ্ট কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউটরের দপ্তর থেকে পাওয়া এক নথিতে এসব তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিসূত্র ও নথিপত্র থেকে আরও জানা যায়, শুরু থেকেই শহিদ ইসলামের বিরুদ্ধে মানব পাচারের পাশাপাশি মুদ্রা পাচারের অভিযোগ ছিল। এমনকি কুয়েতে শহিদ ইসলামের বাড়ির গ্যারেজে রাখা গাড়ি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালিয়ে চেকসহ আর্থিক লেনদেনের বেশ কিছু প্রমাণ পেয়েছে সে দেশের গোয়েন্দারা।

গতকাল শুক্রবার আরবি দৈনিক আল কাবাস সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, বাংলাদেশের সাংসদের বিরুদ্ধে আলাদা দুটি মামলা হয়েছিল। এর একটি ঘুষ লেনদেন আর মানব পাচার নিয়ে, অন্যটি মুদ্রা পাচারের। মুদ্রা পাচারের মামলায় তাঁর সাজা হতে পারে। সাংসদ শহিদ এখন কুয়েতের কারাগারে রয়েছেন।বিজ্ঞাপন

কুয়েতের সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলো আভাস দিয়েছে, সাংসদ শহিদের আইনজীবী রায়ের বিরুদ্ধে আগামী সপ্তাহে আপিল করতে পারেন। ওই সময় সরকারি কৌঁসুলির পক্ষ থেকে শাস্তি বাড়ানোর আবেদন জানানো হতে পারে।

কুয়েতের স্থানীয় গণমাধ্যমে সাংসদের সাজার বিষয়টি জেনেছি। এখন পর্যন্ত কুয়েত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কিছু জানায়নি।

মেজর জেনারেল আশিকুজ্জামান, কুয়েতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

এদিকে বিদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের একজন সাংসদ দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও এ বিষয়ে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানে না। কুয়েতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল আশিকুজ্জামান গতকাল সকালে ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুয়েতের স্থানীয় গণমাধ্যমে সাংসদের সাজার বিষয়টি জেনেছি। এখন পর্যন্ত কুয়েত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কিছু জানায়নি।’

তিনি বলেন, ‘গত বছরের আগস্টে কুয়েতে এসে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ বিষয়টি জানার চেষ্টা করেছি। তবে কুয়েত আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানায়নি।’

সাংসদ শহিদকে সাজা দেওয়ার রায়ের ব্যাপারে কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউটরের দপ্তর একটি পর্যবেক্ষণ দেয়। ওই নথি থেকে জানা যায়, কুয়েতের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) কর্মকর্তারা বাংলাদেশের সাংসদের বিরুদ্ধে আনা মানব পাচারের অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ৭ জুন সময়কালের বিভিন্ন ঘটনা আমলে নিয়েছেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণ–সম্পর্কিত নথিতে বলা হয়েছে, তথ্য গোপন ও জালিয়াতি করে প্রত্যেকের কাছ থেকে সাত থেকে সাড়ে সাত লাখ টাকা নিয়ে বাংলাদেশিদের কুয়েতে পাচার করতেন সাংসদ শহিদ। কুয়েতে টোবাড জেনারেল ট্রেডিং অ্যান্ড কন্ট্রাকটিং কোম্পানি ও মারাফিয়া কুয়েতিয়া গ্রুপের (শহিদ ইসলামের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের কথা বলে তাঁদের নেওয়া হতো। কুয়েতে গিয়ে বাংলাদেশের দুর্ভাগা নাগরিকেরা জানতে পারেন, তাঁদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর যে চুক্তির কথা বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় বলা হয়েছিল, সেগুলোও জাল।

রায়ের পর্যবেক্ষণ–সম্পর্কিত নথিতে আরও বলা হয়, বিপুল টাকা খরচ করে কুয়েতে পৌঁছানো বাংলাদেশিদের কম বেতনে দীর্ঘ সময় কাজ করতে বাধ্য করা হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের দিনে ১৬ ঘণ্টা অমানবিক পরিবেশে কাজ করতে হয়েছে। কোনো কিছু নিয়ে অভিযোগ করলে বাংলাদেশিদের পেটানো হতো। শ্রমিকেরা কারও কাছ থেকে বকশিশ পেলে তার একটি অংশ শহিদ ইসলামের লোকজনকে দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল।

মামলার আসামি ১৩ জন

কুয়েতের আদালতের রায়ের পর্যবেক্ষণ থেকে জানা গেছে, শহিদসহ ওই মামলায় আসামি ছিলেন ১৩ জন। শহিদ ইসলাম ছাড়া তাঁর কর্মী মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলামের কারাদণ্ড হয়েছে, যিনি সেখানে কারাগারে রয়েছেন। এ ছাড়া কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরখাস্ত হওয়া আন্ডার সেক্রেটারি মেজর জেনারেল মাজেন আল জারাহ, প্রভাবশালী কুয়েতি ব্যবসায়ী নাওয়াফ আল মুতাইরি ও দেশটির জনশক্তি বিভাগের উপমহাপরিচালক হাসান আল খাদেরের কারাদণ্ড হয়েছে। এ ছাড়া কুয়েত থেকে পলাতক শহিদ ইসলামের প্রতিষ্ঠানের কর্মী মোহাম্মদ হেলাল হোসেন ও মিলন কান্তি পাল এবং সিরিয়ার নাগরিক মেটানিওস ইসা সামাকে আদালত কারাদণ্ড দিয়েছেন। অর্থাৎ মামলায় সাজা হয়েছে আটজনের।

কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউটরের দপ্তর একটি নথি থেকে জানা যায়, কুয়েতের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) কর্মকর্তারা বাংলাদেশের সাংসদের বিরুদ্ধে আনা মানব পাচারের অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ৭ জুন সময়কালের বিভিন্ন ঘটনা আমলে নিয়েছেন।

মামলা থেকে কুয়েতের দুই সাংসদ সাদুন হামাদ আল-ওতাইবি ও সালাহ খুরশিদ এবং সাংসদ শহিদের প্রতিষ্ঠানের কর্মী শেখ মাসুদুর রহমান, আমান উল্লাহ ও মোহাম্মদ মাহবুব ইসলাম খালাস পেয়েছেন।

কার কী অপরাধ

কুয়েতের আদালতের রায়ের পর্যবেক্ষণে কাকে কোন অপরাধে সাজা দেওয়া হয়েছে, তার উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরখাস্ত হওয়া আন্ডার সেক্রেটারি মেজর জেনারেল মাজেন আল জারাহ বিপুল টাকা ঘুষ নিয়ে শহিদ ইসলামকে লোক নিয়োগে সহায়তা করেছিলেন।

কুয়েতের জনশক্তি বিভাগের উপমহাপরিচালক হাসান আল খাদেরও ঘুষ নিয়ে বাংলাদেশের সাংসদকে সহায়তা করেছেন।

এদিকে সাংসদ শহিদ ইসলামের শাস্তির বিষয়টি কুয়েতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের চরম অস্বস্তিতে ফেলেছে। এ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের (বিবিসি) সহসাধারণ সম্পাদক এবং বহুজাতিক সংস্থা গালফ নাসিমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আকবর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন সাংসদের এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। কারণ, এখানে বাংলাদেশের অনেক নাগরিকই রয়েছেন, যাঁরা সুনামের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে কাজ করে দেশের সম্মান বাড়িয়েছেন। সাংসদের অপকর্ম আজ সব অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *